
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আমাদের জীবনে অনেক সহজতা এনে দিয়েছে।এটি শুধু দৈনন্দিন কাজগুলোকে সহজ করে তোলেনি, বরং এটি মানুষের দক্ষতাকে বাড়িয়ে তুলেছে। তথ্য বিশ্লেষণ, ভাষান্তর, এবং বিভিন্ন ডেটা থেকে সমাধান বের করার ক্ষমতার কারণে এআই আজকের বিশ্বে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তবে, এই সুবিধাগুলোর পাশাপাশি এর অন্ধকার দিকও রয়েছে। সাইবার অপরাধীরা এআই-এর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণার নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করছে।এআই-এর সাহায্যে তৈরি ফিশিং মেসেজগুলো আগের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। সেগুলো দেখতে এতটাই বিশ্বাসযোগ্য যে সাধারণ মানুষ সহজেই প্রতারণার শিকার হয়। বানান বা ব্যাকরণের ভুল, যা একসময় ফিশিং মেসেজ চেনার প্রধান উপায় ছিল, এখন আর চোখে পড়ে না। এমনকি, বিভিন্ন ভাষায় একই মেসেজ অনুবাদ করে অপরাধীরা বৈশ্বিক স্তরে প্রতারণা করতে সক্ষম হচ্ছে।বড় ডেটা সেট বিশ্লেষণেও এআই অপরাধীদের সাহায্য করছে। ডেটা চুরির পর এত বিশাল তথ্য বিশ্লেষণ করা মানুষের জন্য কঠিন ছিল, কিন্তু এআই দ্রুততার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করে আনতে পারে। এটি অপরাধীদের পক্ষে সহজ করে তুলেছে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ডের তথ্য এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা।পরিচয় চুরি এখন আরও সহজ হয়ে গেছে। এআই ব্যবহার করে অত্যন্ত নিখুঁত ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করা যায়। পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং জন্ম সনদসহ এমন সব নথি তৈরি করা সম্ভব, যা দেখতে একেবারে আসলের মতো। এমনকি বায়োমেট্রিক যাচাই ব্যবস্থাও অনেক সময় এগুলো শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়।ডিপফেক প্রযুক্তি অপরাধীদের আরও শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এটি ব্যবহার করে তারা মানুষের মুখ এবং কণ্ঠস্বর এত নিখুঁতভাবে নকল করতে পারে যে প্রকৃত আর নকলের পার্থক্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এর ফলে, ভিডিও কনফারেন্স বা ফোন কলেও মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছে।সম্প্রতি, একটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানে ডিপফেক ভিডিও ব্যবহার করে $২৫ মিলিয়ন ডলার চুরি করা হয়েছে। এই ঘটনাটি দেখায় যে ডিপফেক প্রযুক্তি কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে শুধু ব্যক্তিগত মানুষ নয়, বড় প্রতিষ্ঠান এবং সরকার পর্যন্ত প্রতারণার শিকার হতে পারে।এআই শুধু মানুষের মুখ এবং কণ্ঠস্বরই নয়, তাদের আচরণ ও ব্যক্তিত্বকেও নকল করতে সক্ষম। কিছু সামান্য তথ্য ব্যবহার করে এআই এমনভাবে ব্যক্তিত্ব ও মতামত নকল করতে পারে, যা প্রতারণা আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।এআই-এর সাহায্যে প্রতারণার ঘটনা এখন দিন দিন বাড়ছে। সাইবার অপরাধীরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পদ্ধতি বের করছে। এআই এমন ভুয়া পরিচয় তৈরি করতে পারে, যা একেবারে বাস্তব বলে মনে হয়। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ, এবং গৃহহীনদের পরিচয় তথ্য চুরি করে তা দিয়ে ভুয়া পরিচয় বানানো হচ্ছে।এই ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে ব্যাংক লোন নেওয়া বা ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করা হয়, যার দায় শেষ পর্যন্ত প্রকৃত পরিচয়ধারীর ওপর পড়ে। এমনকি, কিছু ক্ষেত্রে ভুয়া কাগজপত্র ব্যবহার করে অপরাধীরা অবৈধ কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।ডার্ক ওয়েব থেকে চুরি করা তথ্য কিনে এবং তা বিশ্লেষণ করে অপরাধীরা বড় ধরনের আর্থিক প্রতারণার পরিকল্পনা করছে। বড় বড় ডেটা সেট থেকে ছোট ছোট প্যাটার্ন বের করে তারা প্রতারণার কৌশল নির্ধারণ করছে।ডিপফেক প্রযুক্তি, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি অংশ, মানুষের জীবনে এক নতুন ধরনের হুমকি নিয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে এমন ভিডিও তৈরি করা যায়, যা আসল বলে মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে তা সম্পূর্ণ নকল।ডিপফেক কেবল মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই নয়, তাদের মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতেও ব্যবহৃত হচ্ছে। বাস্তবের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হওয়ায় প্রতারণার শিকার হওয়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়।বিশ্বব্যাপী এআই-সহায়ক প্রতারণা বন্ধ করার জন্য সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে। তবে, এআই-এর ক্ষমতা দিন দিন বেড়ে চলায় এটি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে।এআই-এর অপব্যবহার রোধ করার জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং মানুষের সচেতনতার সমন্বয় প্রয়োজন। প্রতিটি তথ্য যাচাই করা এবং সন্দেহজনক ইমেইল বা মেসেজ এড়িয়ে চলা অপরিহার্য।সাইবার অপরাধীরা যে পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করছে, সেগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সেগুলো চেনার উপায় শিখে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে এবং এর অপব্যবহার রোধে আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।এআই-এর এই অন্ধকার দিক সম্পর্কে আরও গবেষণা ও উন্নয়ন প্রয়োজন, যাতে এই প্রতারণাগুলো রোধ করা সম্ভব হয়। প্রতিটি মানুষের সচেতনতা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই এই সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।যতদিন এআই উন্নত হবে, ততদিন সাইবার অপরাধীরা এর অপব্যবহার করার সুযোগ খুঁজে পাবে। তাই, আমাদের কেবল প্রযুক্তির ওপর নির্ভর না করে নিজের বুদ্ধিমত্তা এবং সতর্কতা দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।