আন্তর্জাতিক চক্রের হ্যাকিংয়ের শিকার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের খোয়া যাওয়া অর্থ উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা দায়ের করেছে। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে তাতে এক্ষেত্রে ভালো অগ্রগতিও হয়েছে, যা স্পষ্টই বোঝা যায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের সিদ্ধান্তে। যেখানে আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলা চালিয়ে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে।
এটি এই মামলার প্রাথমিক বিজয় হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কারণ, আদালতে মামলা দায়ের করার পর সেই মামলার বিচার কাজ চলবে কিনা। সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত পাওয়ার পরই মামলার আসল বিচারিক কাজ শুরু হয়। কোনো মামলা দায়েরের পর আদালত প্রথমেই দেখার চেষ্টা করে এই মামলার মেরিট,অভিযোগের ভিত্তি এবং প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ কতটা শক্ত এবং সে অনুযায়ী মামলার বিচার কাজ চলবে কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। আদালতের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে চলতে আর কোনো বাধা রইল না, যা বিচারের রায় পর্যন্ত যেতে পারবে। এর আগের একটি রায়ের পর্যবেক্ষণেও যুক্তরাষ্ট্রের আদালত একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিল। সেখানে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছিল যে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গচ্ছিত রিজার্ভের অর্থ হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ফিলিপিন্সে সরিয়ে নিয়ে সেখানে আত্মসাৎ করার ক্ষেত্রে আরসিবিসি ব্যাংকের সরাসরি যোগসাজশ ছিল। আদালতের রায়ের সেই মন্তব্যটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এই মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে খুব ভালো কাজ করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই রিজার্ভ হ্যাকিং ঘটনার পর থেকে বিভিন্ন সময় প্রাসঙ্গিকতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি প্রায় দুই ডজনেরও অধিক কলাম লিখেছি। প্রতিটি কলামে জোর দিয়ে উল্লেখ করেছি যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া রিজার্ভের অর্থ উদ্ধারের একমাত্র পথ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা দায়ের করা। এটি শুধু আমার কথা নয়। বর্তমান সময়ে সংঘটিত মানি লন্ডারিং এবং আর্থিক জালিয়াতির ঘটনার বিষয়ে যারা খোঁজখবর রাখেন, তারাও আমার সঙ্গে একমত হবেন। কেননা, এ সংক্রান্ত যত আইন এবং বিধিবিধান আছে, যেমন- মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ইউ এস প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট, কেওয়াইসি (নো ইয়র কাস্টোমার), গ্রাহকের লেনদেন প্রোফাইল, প্রদানকারী ব্যাংকের দায়-দায়িত্ব (পেয়িং ব্যাংকের দায়িত্ব) এর সবকিছুই অমান্য করে ফিলিপিন্সের আরসিবিসি ব্যাংক সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই লেনদেন সম্পন্ন করেছে। সুতরাং এর দায়-দায়িত্ব যে আরসিবিসি ব্যাংকের, তা প্রমাণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোটেও বেগ পাবার কথা নয়। এই বিষয় নিয়ে যতই লেখালেখি করি না কেন আমাদের মতো সাধারণ মানুষের লেখার ওপর ভরসা করে যে বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেয়নি, তা ভালোভাবেই বুঝতে পারি। এক্ষেত্রে নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঠিক সিদ্ধান্ত ও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন এবং মামলা দায়েরের জন্য সাহস যুগিয়েছেন। এ কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা দায়ের করে এই পর্যন্ত নিয়ে এসে একটু আশার আলো দেখানো সম্ভব হয়েছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে এই মামলার পেছনে লেগে আছে এবং আগামীতেও যদি লেগে থাকে, তাহলে রিজার্ভের খোয়া যাওয়া অর্থ ফিরে পেতে মোটেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। এর সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত যুক্তরাষ্ট্রের আদালতেই আছে, যা রেফারেন্স হিসেবে আগের একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছি এবং বিষয়টির গুরুত্বের কারণে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আবারও উল্লেখ করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাকিং হওয়ার আগে একই রকম ঘটনার শিকার হয়ে ইকুয়েডরের একটি ব্যাংক ১২ মিলিয়ন ডলার হারিয়েছিল। তারাও যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা দায়ের করে সম্পূর্ণ অর্থ ফিরে পেতে সক্ষম হয়েছে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া অর্থ ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী হতেই পারি। শুধু বাংলাদেশ ব্যাংককে ধৈর্য ধরে খুবই সতর্কতার সঙ্গে মামলাটি চালিয়ে যেতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের রায় বিপক্ষে গেলে তা যে কি ভয়ঙ্কর হতে পারে তা আমরা যারা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, বিশেষ করে অ্যান্টি মানিলন্ডারিং বিষয় নিয়ে খোঁজখবর রাখি, তারা খুব ভালোভাবেই জানি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করতে পারি কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে যে, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে আছে সবচেয়ে ক্ষমতাধর এবং নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং বিচার বিভাগ। এই কারণেই মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারে লেনদেন করতে এবং ডলারে অর্থ জমা রাখতে সবচেয়ে নিরাপদ বোধ করে।
নিয়মবহির্ভূত লেনদেনে জড়িত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং আদালত যে কি ভয়ঙ্কর শাস্তি দিতে পারে, তা ভুক্তভোগী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ভালোভাবেই জানে। যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা আদালতের রায় যে কি মারাত্মক হতে পারে, তা দু-একটি দৃষ্টান্ত থেকে আঁচ করা যায়। বিশ্বের অন্যতম এক শক্তিশালী দেশ জার্মানির ডয়েচ ব্যাংক এক সময় বিশ্বের বৃহত্তম এক ব্যাংক ছিল। এই ব্যাংকের নাম শুনলেই অন্যান্য ব্যাংক বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের লেনদেন করে ফেলত মুহূর্তের মধ্যে। সেই ডয়েচ ব্যাংক নিয়মবহির্ভূত কিছু লেনদেনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস এই ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রথম ২৬ বিলিয়ন ডলার জরিমানা করে। এই বিশাল অঙ্কের জরিমানা ব্যাংকের মূলধনের থেকেও বেশি হওয়ায় জরিমানার পরিমাণ কমিয়ে ১৪ বিলিয়ন ডলারে নামানো হয়। তারপরও এত বিশাল অঙ্কের জরিমানা গুনতে গিয়ে এই ব্যাংক কয়েক বছর ধরে টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত।
২০০৮ সালের সাবপ্রাইম মর্টগেজ কেলেঙ্কারির পর লাইবর ইন্টারেস্ট রেট জালিয়াতি ছিল এই শতাব্দীর ভয়াবহতম আর্থিক কেলেঙ্কারি। লাইবর রেট কেলেঙ্কারির মাত্রা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এই রেটের পতন ঘটিয়ে ছেড়েছে। এত বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা ইউরোপ, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের নিয়ন্ত্রক সংস্থা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এক নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান বিষয়টি নিয়ে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করায় এই আর্থিক কেলেঙ্কারির মূল অভিযুক্তের বিচার যুক্তরাজ্যের আদালতে সম্পন্ন হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা দায়েরের আরও একটি বিশেষ সুবিধা হচ্ছে এখানকার আদালত শুধু বাদীর বিষয়টিই যে দেখবে তেমন নয়। সেই সঙ্গে আদালত এটাও গুরুত্ব দিয়ে দেখার চেষ্টা করে যে, মামলার কোনো পক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থার (ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম) জন্য হুমকি কিনা! অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের সিস্টেমকে অপব্যবহার করছে কিনা।
হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যদি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গচ্ছিত আরেকটি দেশের রিজার্ভের টাকা খুব সহজেই বের করে নিয়ে কোনো ব্যাংকে বা প্রতিষ্ঠানে লেনদেন নিষ্পত্তি করে ফেলা যায়, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান যে যুক্তরাষ্ট্রের সিস্টেম ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত নয়, তা আদালত ভালোভাবেই বুঝতে চেষ্টা করবে। এসব বিষয় আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যেহেতু জানি, সেহেতু আরসিবিসি ব্যাংক এবং তাদের আইনজীবীও বিষয়গুলো ভালোভাবেই জানে। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে অধিকাংশ আর্থিক জালিয়াতির মামলা যেভাবে নিষ্পত্তি হতে দেখেছি সেই আলোকে ধারণা করা যায় যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ ফিরে পেতে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করা নাও লাগতে পারে। তার আগেই বিষয়টি সুরাহা হয়ে যেতে পারে। মূল মামলার এক/দুটি শুনানি হওয়ার পরই আরসিবিসি ব্যাংক থেকে আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির প্রস্তাব আসার সমূহ সম্ভাবনা আছে। যুক্তরাষ্ট্রে মামলা আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি, যাকে এখানকার আইনের ভাষায় আউট অব কোর্ট সেটেলমেন্ট বলা হয়ে থাকে, সেটি খুবই জনপ্রিয়। আইনসম্মত ব্যবস্থা মামলা চলাকালে যদি প্রধান অভিযুক্ত আরসিবিসি ব্যাংকের কাছ থেকে মামলাটি আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির প্রস্তাব আসে এবং সেটি যদি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং তাদের আইনজীবীর কাছে সন্তোষজনক মনে হয়, তাহলে বিষয়টি কিভাবে নিষ্পত্তি হতে পারে তার একটি পূর্ব প্রস্তুতি আগে থেকেই থাকা প্রয়োজন।
একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের খোয়া যাওয়া সমুদয় অর্থ তো ফেরত দিতেই হবে, সেই সঙ্গে মামলা সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক যে পরিমাণ আইনি খরচ ব্যয় করবে, সেই টাকাও আদায় করে নিতে হবে। মামলার খরচসহ সম্পূর্ণ অর্থ ফেরত দিতে হবে এই কারণে যে, এই অর্থ মুনাফা অর্জনকারী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নয়। এই অর্থ মূলত একটি দেশের জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ। তাই অভিযুক্ত ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান সমুদয় অর্থ ফেরত দিতে বাধ্য। আমরা এভাবেই মামলাগুলো যুক্তরাষ্ট্র-কানাডায় আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হতে দেখি। সেই আলোকেই বিষয়টি উল্লেখ করলাম। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পদক্ষেপ বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দেশের জন্য ভালো হবে তা অবশ্য বিজ্ঞ আইনজীবী ভালো বলতে পারবেন। আমরা সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকলাম।