বিশ্বব্যাপী মিথ্যা তথ্য এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর সমস্যা আজকের দিনে একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই সমস্যাটি সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে এবং ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মিথ্যা তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর সংবাদ সমাজে একটি শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং ধর্মীয় সহিংসতার মূল উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ভারতের মিডিয়া এবং সামাজিক মাধ্যমে এমন কিছু বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশিত হয়েছে, যা ধর্মীয় সহিংসতা এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে প্রচারিত হয়েছে।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১,৪৯০ জন বিশেষজ্ঞের মতামতের ভিত্তিতে ভারত মিথ্যা তথ্য এবং বিভ্রান্তি ছড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে। এই গবেষণা আমাদের সতর্ক করেছে যে ভারতের মিডিয়ার খবর সম্পর্কে বিশ্বাস করার আগে পুনরায় চিন্তা করা উচিত। ভারতে সামাজিক মাধ্যম এবং স্মার্টফোনের বিস্তারের ফলে মিথ্যা তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা রাজনৈতিক উত্তেজনা, সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, এবং সামাজিক বিভাজনকে আরও গভীর করছে। উদাহরণস্বরূপ, হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে মিথ্যা খবর ছড়ানোর ফলে বাস্তব জীবনে সহিংসতা ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
একটি সাম্প্রতিক ভাইরাল হওয়া ঘটনায়, মাশরাফি বিন মুর্তজার বাড়িতে আগুন লাগার পুরনো একটি ছবিকে ভুলভাবে লিটন দাসের বাড়ির ঘটনা হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। এমনকি ৩ থেকে ৫ বছরের পুরনো খবরগুলোও নতুন ঘটনা হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং কিছু ভারতীয় মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশের ঘটনা বলে ভুয়া খবর প্রচার করা হচ্ছে। এই বিষয়টি নিয়ে আকাশ ব্যানার্জিও (The Deshbhakt) একটি ভিডিও তৈরি করেছেন যেখানে তিনি ভারতের মিডিয়ার বিভ্রান্তিমূলক প্রচার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বিশেষত, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সংঘর্ষ নিয়ে ভুয়া খবর প্রচার করার ঘটনা প্রায়শই দেখা যায়। যেমন, একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনার ভিডিও ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়েছিল, যেখানে দাবি করা হয়েছিল যে এটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের সংঘর্ষের দৃশ্য।

২০২১ সালে কুমিল্লায় দুর্গা পূজা উদযাপনের সময় সংঘটিত একটি ঘটনার ছবি ও ভিডিওকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ভারতের কিছু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী এই পুরনো ছবি ও ভিডিওগুলোকে বর্তমান পরিস্থিতি বলে দাবি করে, যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়াতে সাহায্য করেছিল। ভুয়া খবরের মাধ্যমে ধর্মীয় উস্কানি দেওয়ার একটি বড় উদ্দেশ্য থাকে। যেমন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ভুয়া খবর ছড়িয়ে ভারতের কিছু উগ্রবাদী গোষ্ঠী সামাজিক মাধ্যমে উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা করে। এই ধরনের খবরের মধ্যে রয়েছে মন্দির ভাঙচুর, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে সহিংসতার ভুয়া দাবি। এগুলো মূলত ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি করতে এবং দুই দেশের মধ্যে বিভাজন বাড়াতে ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশে সম্প্রতি কিছু ভুয়া ভিডিও এবং ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণের অভিযোগ তুলে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কিছু লোক একটি মেয়েকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর সেখানে ক্যাপশন দেওয়া হয়েছে “বাংলাদেশে একটি হিন্দু মেয়েকে অপহরণ করা হচ্ছে।” প্রকৃত ঘটনা ছিল ভিন্ন। অপহরণকারী ব্যক্তি আসলে ওই হিন্দু মহিলার মাদকাসক্ত স্বামী, যিনি ছয় মাস আগে তার থেকে আলাদা হয়েছিলেন। গ্রামবাসী সেই মহিলাকে উদ্ধার করে মাদকাসক্ত স্বামীর হাত থেকে বাঁচান।
আরেকটি ভিডিওতে চট্টগ্রামের একটি দোকানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেখিয়ে দাবি করা হয়েছিল যে, হিন্দু সম্প্রদায়ের দোকান পুড়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে সেই দোকানের মালিক ছিলেন সালমান ফজলুর রহমান, যিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও, লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট বাজারে ১৫টি প্লাস্টিক ও কাপড়ের দোকানে আগুন লাগার ঘটনাকে হিন্দু-মুসলিম সংঘাত হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। আরেকটি ভাইরাল হওয়া ছবিতে উত্তরা এলাকায় ডাকাতদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে, যা ভুয়া ক্যাপশন দিয়ে মন্দির রক্ষার লড়াই হিসেবে প্রচারিত হয়েছে। এমনকি রাজ প্যালেস কফি শপের আগুনের ঘটনাকেও মন্দির হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং তা জ্বলছে বলে দেখানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, এটি একটি কফি শপ ছিল যেখানে অসাবধানতাবশত আগুন লেগেছিল।
এটা সত্য যে কিছু ঘটনা হিন্দু পরিবারগুলোর সঙ্গে ঘটেছে, কিন্তু তা ধর্মীয় সংঘাত নয়, বরং সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আজ শুক্রবার (১৬ আগস্ট) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ড. ইউনূস বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার খবরগুলো অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। তিনি ভারতীয় সাংবাদিকদের বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান এবং সংখ্যালঘু সুরক্ষা ইস্যুতে মাঠ থেকে রিপোর্ট করতে বলেন।
এই পরিস্থিতিতে, সাধারণ জনগণের উচিত তথ্য যাচাই করার পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং কোনো তথ্য শেয়ার করার আগে তার সত্যতা নিশ্চিত করা। মিথ্যা তথ্য ছড়ানো রোধে ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং সঠিক তথ্য যাচাই প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মিডিয়া এবং সাধারণ মানুষের একসাথে কাজ করা আবশ্যক, যাতে বিশ্বব্যাপী বিভ্রান্তি ও মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়ি রোধ করা যায়।

রাকিব হোসেন, লেখক, গবেষক এবং উন্নয়নকর্মী।
পিএইচডি ফেলো, অর্থনীতি