যতদূর চোখ যায় শুধু ধু-ধু বালু। নদীর মধ্যে জেগে ওঠা চর কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি নয়। ঢাকার পাশে কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজারের দৃশ্য এটি। মাত্র বছর দেড়েক আগেও বিশাল এই অঞ্চল ছিল গাছগাছালিতে ঢাকা ছায়া-সুনিবিড়, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। তিন ফসলি এসব জমি থেকে উৎপাদিত সবজি চাহিদা মেটাত রাজধানীর মানুষের। তবে সে এখন অতীত। এসব জায়গা দখলে নিয়েছে আঁটি মডেল টাউন নামের একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান। স্থানীয়ভাবে যা সুজন হাউজিং নামে পরিচিত। সরকারের সব প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত, বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এখনো চলছে দখলের উৎসব। বালু ফেলে দখলে নেওয়া হচ্ছে সাধারণ মানুষের জমি। প্রতিবাদ করলে করা হয় এলাকাছাড়া। যদিও গত মঙ্গলবার রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অভিযান চালিয়েছে আবাসন কোম্পানিটিতে। ভাঙা হয়েছে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা অনেক ভবন।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলাটি রাজউকের আওতাধীন। এই এলাকায় রাজউক অনুমোদিত কোনো আবাসন কোম্পানি নেই। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে কোনো আবাসিক প্রকল্প নিতে হলে রাজউক থেকে নকশাসহ অনুমোদন নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা অনুযায়ী এই অনুমোদন নিতে হয়। এ ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও ছাপড়ত্র নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে খাল-বিল কিংবা পরিবেশ নষ্ট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে ওঠে কি না, সে বিষয়ে নজর রাখা হয়। রাজউকের পক্ষ থেকে গত দুই বছরে বেশ কয়েকবার ১৫টি কোম্পানিকে নির্দিষ্ট করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, বালু দিয়ে প্রকল্প এলাকা ভরাট ও প্লট বিক্রির বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে হবে। ১৫টি কোম্পানির মধ্যে অন্যতম আঁটি মডেল টাউন। তবে রাজউকের সেই সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই দিনের পর দিন বালু ভরাট চলছে। বিক্রি করা হচ্ছে প্লটও।
কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজার ঘেঁষে কয়েক বিঘা জমিতে একটি আবাসন প্রতিষ্ঠান চালু হয় ২০১২-১৩ সালের দিকে। স্থানীয় ইবরাহীম মিয়া সুজন নামে এক ব্যক্তি এটি চালু করেন। তবে এক যুগের ব্যবধানে মাত্র কয়েক বিঘা জমি নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই আবাসন কোম্পানিটি ফুলে-ফেঁপে এখন মহিরুহ। দেদার ভরাট চলছে আশপাশের কৃষিজমি। গড়ে উঠেছে সুউচ্চ ভবন। সরকারের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে একের পর এক খাল-বিল ও জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। আয়তন বেড়েছে কোম্পানির।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আবাসন কোম্পানিটির পুরোনো অংশের প্রায় সব প্লট বিক্রি হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে উঁচু ভবন। যদিও এসব ভবন নির্মাণে রাজউকের অনুমতি নেওয়া হয়নি। তবে নির্মিত এসব ভবন এবং এলাকা দেখিয়ে নতুন প্রকল্পে প্লট বিক্রি শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এদিকে গত মঙ্গলবার আঁটি মডেল টাউন এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালায় রাজউক। ওই অভিযানে ৮টি ভবনের আংশিক অপসারণসহ দুটি ভবনের মালিককে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় এবং ৩টি ভবনের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। অভিযানে নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনির হোসেন হাওলাদার। তিনি বলেন, এসব ভবনের মালিকরা পরবর্তী সময়ে রাজউক অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করবেন এবং নকশাবহির্ভূত অংশ নিজ দায়িত্বে ভেঙে ফেলবেন মর্মে অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেছেন। জনস্বার্থে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
রাজউকের অভিযানের পর থেকেই আতঙ্কে রয়েছেন আঁটি মডেল টাউন এলাকার প্লট এবং বাড়ির মালিকরা। তারা বলছেন, চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিয়ে এসব প্লট বিক্রি করেছেন। আমরা তাদের কথায় আশান্বিত হয়ে কিনেছি। এরপর নিজেদের জীবনের সব উপার্জন দিয়ে বাড়ি করেছি। এখন রাজউক বলছে অনুমোদন নেওয়া হয়নি। আবাসন কোম্পানিরও নাকি অনুমোদন নেই।
সরেজমিন আঁটি মডেল টাউন এলাকায় ঘুরে এবং প্লট ও বাড়ির মালিকদের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলছেন, কথা দিয়ে এখন কথা রাখছে না আবাসন কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। ওই সময় বলা হয়েছিল, এই এলাকা রাজউকের বাইরে। সে ক্ষেত্রে সরকারি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু এখন উল্টো। কোম্পানির অনুমোদন নেই। বাড়ি করতে রাজউকের অনুমোদন নিতে হবে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করার পরে ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। জরিমানা গুনতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন বাড়ির মালিক বলেন, এই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে মালিকপক্ষ। রাজউকের অভিযানের পরে আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তারা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চান না। উল্টো হুমকি-ধমকি দেন। এভাবে চলতে পারে না। মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বিক্রি করে এমন আচরণ মেনে নেওয়া হবে না। প্রয়োজনে আমরা কোম্পানির মালিকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যাব।
ভুক্তভোগীদের এসব কথার সত্যতা পাওয়া যায় আবাসন কোম্পানিটির কর্ণধার ইবরাহীম মিয়া সুজনের কথায়ও। সুজন বলেন, অবৈধভাবে ভবন বানালে তো ভাঙবেই। তারা অবৈধভাবে বানিয়েছেন কেন?
কেবল প্রথম ধাপের ক্ষেত্রেই নয়, দ্বিতীয় ধাপে বিশাল এলাকাজুড়ে বালু ভরাট করে তৈরি করা হচ্ছে আবাসন। সরেজমিন নতুন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই দখলকৃত জায়গার পরিমাণ বাড়ছে। মাইলের পর মাইল, যতদূর চোখ যায় শুধু বালু। নতুন নতুন এলাকা যুক্ত হচ্ছে এই ভরাটের তালিকায়। হাউজিং এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মোটরসাইকেল বাহিনী। বহিরাগত কোনো ব্যক্তি হাউজিং এলাকায় প্রবেশ করলেই পড়তে হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে। পথে পথে নিরাপত্তা চৌকি।
কথা হয় আঁটিবাজার সংলগ্ন রউফ মিয়ার সঙ্গে। বংশ পরম্পরায় এই এলাকায় বাস করলেও আঁটি মডেল টাউনের কারণে এখন তিনি উদ্বাস্তু। পুরো পরিবার এলাকাছাড়া। তিনি বলেন, এই এলাকার মানুষের প্রধান পেশা ছিল কৃষি। রাজধানীর সবজির চাহিদা মেটাত আমাদের এই এলাকা। কিন্তু সুজন হাউজিং সব বালু দিয়ে ভরাট করেছে। কিছুই নেই। খাল-বিল সব দখলে নিয়েছে।
স্থানীয় আশরাফুল নামে একজন বলছিলেন আঁটি মডেল টাউনের দখলের প্রক্রিয়া সম্পর্কে। তিনি বলেন, রাতের আঁধারে জমির মালিকের অনুমতি ছাড়াই বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলা হয়। পরে প্রতিবাদ করলে বালু ভরাট বাবদ শতাংশপ্রতি তিন লাখ টাকা দাবি করেন। পাশাপাশি হাউজিংয়ের রাস্তা বাবদ ২৫ ভাগ জমি ছেড়ে দিতে বলা হয়। এ ছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির লাইন বাবদ দাবি করা হয় বিপুল অঙ্কের টাকা। এরপর বলা হয় আমরা আপনাকে উচ্ছেদ করব না। আপনি আপনার জায়গায় থাকেন, কিন্তু এই নিয়ম মেনে থাকতে হবে। এভাবে অসহায় কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। স্থানীয়রা একজোট হয়ে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল। লাভ হয়নি। কারণ স্থানীয় সব প্রভাবশালী সুজনের পক্ষে।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি কথা হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (পরিবেশগত ছাড়পত্র শাখা) সাবরিন সুলতানার সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আঁটি মডেল টাউন নামের একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছে পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছিল। তাদের এখনো ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। ছাড়পত্রের বিষয়টি মিটিংয়ে প্রসেসিং আছে। আর তারা যদি খাল-জলাশয় ভরাট করে, পরিবেশের ক্ষতি করে; আপনাদের কাছে প্রমাণ থাকলে আপনারা সংবাদ প্রকাশ করেন।’
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম বলেন, কেরানীগঞ্জে রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে এবং ধারাবাহিকভাবে সব হাউজিংয়ে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। এর আগে মিলেনিয়াম সিটি, শতরূপা হাউজিং, মধুসিটি, সুজন হাউজিং ও আঁটি মডেল টাউন উচ্ছেদ করা হয়েছে। বিশেষ করে যেসব জায়গা খাল, নদী ও জলাশয় ভরাট করছে তার বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এরই অংশ হিসেবে উচ্ছেদ কার্যক্রমগুলো হচ্ছে।
তিনি বলেন, যেখানে ইউনিয়ন পরিষদের কোনো ম্যান্ডেট নেই। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইউনিয়ন পরিষদের অনুমোদন নিয়ে এগুলো করছে। তারা বিএনবিসি কোর্ট, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসরণ করছে না। যদি অনুমোদন প্রক্রিয়ায় কোনো জটিলতা থাকে, আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে এলে অবশ্যই আমরা তাদের অনুমোদন প্রক্রিয়াটা সহজ করে দেব। তবে কেরানীগঞ্জে অবৈধভাবে কোনো খাল, সরকারি জমি বা জলাশয় যারাই ভরাট করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ অব্যাহত থাকবে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে দীর্ঘদিন ধরে আঁটি মডেল টাউনের কর্ণধার ইবরাহীম মিয়া সুজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। বারবার ফোন এবং মেসেজ পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি। সরেজমিন আঁটি মডেল টাউনের অফিসে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে গতকাল হোয়াটসঅ্যাপে দীর্ঘ চেষ্টায় পাওয়া যায় সুজন মিয়াকে। তিনি বলেন, ‘কারও অভিযোগ থাকলে স্পেসিফিক তাকে নিয়ে আসেন। দেখি কার কী অভিযোগ।’ রাজউকের উচ্ছেদ অভিযানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অবৈধভাবে ভবন বানালে তো ভাঙবেই। তারা অবৈধভাবে বানিয়েছে কেন? আমরা অবৈধ কিছু করলে আমাদের নামে মামলা করেন। থানা পুলিশ আছে তো!’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানীর বেশ কাছে কেরানীগঞ্জ, আঁটিবাজার এলাকায় কৃষিজমি ও জলাভূমি আছে। এগুলো সংরক্ষিত এলাকা, যেগুলো রাজউক প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) রয়েছে। এই জায়গাগুলোতে পরিকল্পিত নগরায়ণের সম্ভাবনা ছিল। সেটা তো হয়নি বরং বিস্তীর্ণ এলাকা বিভিন্ন বাহিনীর নাম ধরে দখল করা হয়েছে। শুধু রাজউক নয়, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র এ বিষয়ে নির্বিকার।
তিনি বলেন, কারও কৃষিজমি, কারও জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে। এই ভরাটগুলো পুলিশ, জেলা প্রশাসন, রাজউক, ইউনিয়ন পরিষদ সবার চোখের সামনে হচ্ছে। এগুলো যে জলাভূমি, কৃষিজমি তা দিব্যচোখে দেখা যায়, ড্যাপের ম্যাপও খুলে দেখতে হয় না। অথচ এই ভরাট-দখল দিনের পর দিন করতে দেওয়া হয়েছে। জোরালো তো দূরের কথা, প্রশাসনের কোনো ধরনের ভূমিকা নেই।
আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ। ঢাকা তো নষ্ট হয়েছেই, ঢাকার আশপাশের জেলা ও এলাকাগুলোও নষ্ট হচ্ছে। যে জায়গাগুলো আমাদের শস্যভান্ডার ও মৎস্যভান্ডার, সেগুলোও নষ্ট করা হয়েছে। রাজউকসহ অন্যান্য সংস্থার উদাসীনতা এবং পেশিশক্তির কাছে নতি স্বীকারের কারণে টেকসই নগরায়ণ নিশ্চিত হচ্ছে না।