অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখলেও গত এক যুগে এ অর্থনৈতিক করিডোরের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে সামান্যই। ২০০৯ সালের পর গত দেড় দশকে দেশের সড়ক ও রেলপথের উন্নয়নে (বাস্তবায়িত ও চলমান) বিনিয়োগ হয়েছে পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এ সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক করিডোরের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিনিয়োগের মাত্র ৬ শতাংশ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। সংস্থাটি ঢাকা-চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক করিডোরের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করেছে ১২ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার সড়ক দুই থেকে চার লেনে উন্নীত করায়। ৮ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছে দ্বিতীয় কাঞ্চন, দ্বিতীয় মেঘনা ও দ্বিতীয় গোমতী সেতু। এর বাইরে প্রায় ১৮২ কোটি টাকায় ফেনীর মহিপালে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণ এবং সড়ক সংস্কারকাজ চলমান আছে।
অন্যদিকে করিডোরটিতে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিনিয়োগ আছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। এ টাকায় ঢাকা-চট্টগ্রামে বিদ্যমান রেললাইনের সমান্তরালে নতুন আরেকটি লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এর বাইরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকায় ঢাকার পানগাঁওয়ে একটি ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল (আইসিটি) নির্মাণ করেছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। বাড়ানো হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা।
যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত এক যুগে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরে যা বিনিয়োগ হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ না হওয়ায় রেলপথ দিয়ে বাড়ছে না পণ্য পরিবহন। ফলে চাপ বাড়ছে সড়কপথে, যা সামাল দিতে পারছে না চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। সক্ষমতার চেয়ে বেশি পরিমাণ যানবাহন চলায় মহাসড়কটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় একদিকে যেমন যাতায়াতে লাগছে বাড়তি সময়, তেমনি রক্ষণাবেক্ষণেও লাগছে মোটা অংকের টাকা।
অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে নির্মাণ করা দ্বিতীয় রেললাইনটির বেশির ভাগ অংশ মিটার গেজ। এ কারণে লাইনটির পণ্য পরিবহন সক্ষমতা কম। আবার রেলওয়ের প্রয়োজনীয় আইসিডি (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) সক্ষমতাও নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক করিডোরে অপ্রতুল বিনিয়োগের কারণে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, অবকাঠামো উন্নয়নে করিডোরটিকে কোনোভাবেই অবহেলা করা হচ্ছে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সম্প্রসারণ, পুরো রেলপথ ব্রড গেজ করা ও নতুন আইসিডি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। করিডোরের ক্রমবর্ধমান ট্রাফিক চাহিদা বিবেচনায় নিয়েই এসব সরকার কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তারা।
করিডোরটিতে বিনিয়োগে সরকারের বাড়তি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম যেহেতু বাংলাদেশের প্রধান অর্থনৈতিক করিডোর, সেহেতু এ করিডোর দিয়ে কার্গো পরিবহন সক্ষমতা বাড়ানোর দিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল। কার্গো পরিবহন সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য যে ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করা দরকার ছিল, দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের নীতিনির্ধারকরা তা নেননি। এ করিডোরের গুরুত্ব যদি আমরা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারতাম, তাহলে অনেক আগেই আমরা পণ্য পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করে ফেলতাম। আমি নিজেও বিস্মিত যে আমাদের নীতিনির্ধারকরা কেন এ করিডোরটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছেন না?’
তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরের পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে রেল। এজন্য অবকাঠামো বাড়ানো দরকার। কিন্তু এখানে করা হয়েছে মিটার গেজের দুটি লাইন। কনটেইনারের মতো পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে মিটার গেজ রেলপথ খুব বেশি উপযোগী নয়। এর সক্ষমতাও কম। রেলওয়ে হাইস্পিড ট্রেন নিয়ে মাতামাতি করছে। কিন্তু ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে টঙ্গী-ভৈরব ঘুরে চট্টগ্রামে যেতে হচ্ছে, অন্তত ৯০ কিলোমিটার বেশি পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে—এটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক ১০ লেনে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আমি মনে করি, পণ্য পরিবহনের জন্য আলাদা সড়ক গড়ে তোলা না হলে এ করিডোরের পূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে না। পাশাপাশি ব্রড গেজ রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে সংক্ষিপ্ত রেলপথ তৈরি করতে হবে। ঢাকায় আইসিডির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নৌপথেও পণ্য পরিবহন বাড়াতে উদ্যোগী হতে হবে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদ্যমান চার লেন সড়কের সক্ষমতা কম হওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে পণ্য পরিবহনে অতিরিক্ত সময় লাগছে। এতে একদিকে যেমন পরিবহন ব্যয় বাড়ছে, তেমনি মূল্যবান সময়ও নষ্ট হচ্ছে। ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা সময়মতো বন্দরে পণ্য পৌঁছে দিতে পারছি না, এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। চার লেনের রাস্তা আর আমাদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এখন শুনছি, সরকার এ রাস্তা আরো সম্প্রসারণ করবে। কিন্তু আমার মত হলো, যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে শুধু পণ্য পরিবহনের জন্য আলাদা একটা রাস্তা নির্মাণ করা জরুরি। এটা আরো আগেই করা জরুরি ছিল। এছাড়া রেল ও নৌপথেও পণ্য পরিবহনের বিষয়টি মাথায় রেখেও যোগাযোগ অবকাঠামো এবং আনুষঙ্গিক সুবিধা গড়ে তোলা জরুরি।’
একই অভিমত চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সভাপতি নাসির উদ্দীন চৌধুরীর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সারা দেশে সড়ক অবকাঠামো খাতে যেভাবে উন্নতি হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রামে ওই মাত্রায় উন্নয়ন হয়নি। চার লেনের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রীবাহী-পণ্যবাহী সব ধরনের যানবাহন চলে। সড়কের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে হাটবাজারের মতো প্রতিবন্ধকতা। সড়কটি বর্তমানের চাহিদা পূরণের উপযোগী নয়। পণ্যবাহী যানবাহনের ধীরগতি, দুর্ঘটনা, চুরি-ডাকাতিসহ নানা সমস্যা সড়কে বিদ্যমান। বিশেষায়িত সড়ক নির্মাণ না করলে অদূর ভবিষ্যতে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোর বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। সড়কের পাশাপাশি রেলপথের উন্নয়নেও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।’
চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে প্রায় ৩৫ লাখ একক কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়। এর মধ্যে ২৫ লাখ একক কনটেইনার পরিবহন করা হয় ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সড়কপথ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ৮০ শতাংশ কনটেইনার পরিবহন হয় সড়কপথে। আর নৌপথে হয় ১৬ শতাংশ। বাকি ৪ শতাংশ কনটেইনার পরিবহন করা হয় রেলপথে।
অন্যদিকে দেশের প্রধান রফতানি পণ্য গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন খাতের কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের একটা বড় অংশ গড়ে উঠেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোর ঘিরে। এ করিডোরেই রয়েছে দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ২০১৯ সালের পর থেকে নতুন করে আরো ৯৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। অনুমোদিত অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর ৩৭টি পড়েছে বান্দরবান, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জেলায়। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোর। এমন প্রেক্ষাপটে সামনের দিনগুলোয় ঢাকা-চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক করিডোরে যানবাহনের চাপ ও পণ্য পরিবহনের চাহিদা আরো বাড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৩ সালে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। পরে প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ করে সম্ভাব্যতা যাচাই, বিশদ নকশা এবং বিভিন্ন প্রস্তুতিমূলক কাজ করা হয়। যদিও পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটি পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া হয়েছে।
এর বদলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ১০ লেনে উন্নীতের পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী। তিনি বলেন, ‘মহাসড়কটি চার লেন করা হয়েছে বেশিদিন হয়নি। এ সরকারের আমলেই হয়েছে। এখন আমরা সড়কটি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছি। এডিবির সহায়তায় আমরা একটি প্রকল্পের কাজ করছি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়ে যাবে। জানুয়ারি-মার্চের মধ্যে প্রকল্পটি অনুমোদন হবে বলে আমরা আশাবাদী।’
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল করার বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক নয়। ট্রান্সপোর্ট গ্রোথ আমাদের আয়ত্তের মধ্যে আছে। এডিবি আমাদের একটা হিসাব দেবে। সে অনুযায়ী আমরা কাজ করব।’
অন্যদিকে ১১০ কোটি টাকা খরচ করে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণের জন্য একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। যদিও হাইস্পিড ট্রেনের এ উদ্যোগটি শুধু যাত্রী পরিবহনের জন্য। এর বাইরে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার কমাতে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকা ও কুমিল্লার মধ্যে একটি কর্ড লাইন নির্মাণের জন্য বর্তমানে আরেকটি সম্ভাব্যতা করা হয়েছে। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের ধীরাশ্রমে নতুন একটি আইসিডি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের পর ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে পণ্য পরিবহনে রেলের অংশ বহু গুণ বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পণ্য পরিবহনে রেলওয়ের সামর্থ্য খুবই কম। চট্টগ্রাম বন্দরের ৫ শতাংশ পণ্যও আমরা পরিবহন করতে পারি না। আগে আমাদের লাইনের সীমাবদ্ধতা ছিল। ডাবল লাইন করে এটা দূর করা হয়েছে। আইসিডি সুবিধা আমাদের কম। একমাত্র কমলাপুরে আমাদের আইসিডি সামর্থ্য রয়েছে। এটা আমরা ধীরাশ্রমে শিফট করছি। এটা হলে কিছুটা সমস্যা দূর হবে।’ যদিও এটা হতে হতে আরো দু-তিন বছর সময় লাগতে পারে।’