
বর্তমানে ইন্টারনেটের বিশাল একটি অংশ স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার বা বট দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। যদিও কিছু বট ভালো কাজে ব্যবহৃত হয়, তবে অনেক ক্ষতিকারক বটও রয়েছে, যা ব্যবহারকারী ও ব্যবসার জন্য বড় হুমকি সৃষ্টি করছে।ক্ষতিকারক বট বিভিন্ন উপায়ে সাইবার আক্রমণ চালায়, যার মধ্যে অন্যতম হলো ফিশিং স্ক্যাম। এসব বট ব্যবহারকারীর বিশ্বাস অর্জন করে এবং প্রতারকদের জন্য সুযোগ তৈরি করে, যা অর্থনৈতিক ক্ষতি, পরিচয় চুরি এবং ম্যালওয়্যার সংক্রমণের মতো গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বড় ভাষার মডেলের (LLMs) জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিকারক বটের কার্যক্রমও বাড়ছে।২০২৪ সালের ইমপারভা ব্যাড বট রিপোর্ট অনুযায়ী, ক্ষতিকর বট ট্রাফিক টানা পাঁচ বছর ধরে বাড়ছে, যা একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা। ২০২৩ সালে ক্ষতিকারক বট ইন্টারনেট ট্রাফিকের ৩২% দখল করেছিল, যা ২০২২ সালের তুলনায় ১.৮% বেশি। ভালো বটগুলোর ট্রাফিকও কিছুটা বেড়েছে, তবে মানুষের ট্রাফিক কমে ৫০.৪%-এ নেমে এসেছে।ভালো বট সাধারণত ওয়েবসাইট ইনডেক্সিং, সাইবার নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ এবং গ্রাহক সহায়তার জন্য ব্যবহৃত হয়। এগুলো আইটি সুরক্ষা উন্নত করে, স্বয়ংক্রিয় কাজ সহজ করে এবং অনলাইন পরিষেবাকে আরও কার্যকর করে তোলে। তবে বড় সমস্যা হলো, কীভাবে ভালো বট এবং ক্ষতিকারক বটের পার্থক্য নির্ধারণ করা যায়।ক্ষতিকারক বটগুলোর মাধ্যমে স্ক্যাল্পিং বা টিকিট কালোবাজারি সমস্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্ক্যাল্পাররা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একাধিক ব্যবহারকারী তৈরি করে বা হ্যাক হওয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে দ্রুত টিকিট কিনে ফেলে, যা সাধারণ ব্যবহারকারীরা করতে পারে না। পরে তারা এই টিকিটগুলো অনেক বেশি দামে পুনরায় বিক্রি করে, যা সাধারণ মানুষের জন্য বড় অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।এআই প্রযুক্তির উন্নতির ফলে ক্ষতিকারক বটগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এখন এগুলো মানুষের মতো আচরণ করতে পারে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে কোডিং করতে পারে এবং দ্রুত সাইবার আক্রমণ চালাতে সক্ষম। গুগলও স্বীকার করেছে যে তাদের জেমিনি এআইকে ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে।সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এই সমস্যার সমাধানে কাজ করে চলেছেন। উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, বট শনাক্তকরণ প্রযুক্তি এবং আরও কঠোর ওয়েব নিয়মাবলী তৈরির মাধ্যমে বট আক্রমণ কমানোর চেষ্টা চলছে। তবে সাধারণ ব্যবহারকারীদেরও সতর্ক থাকতে হবে এবং সন্দেহজনক লিংক, বিজ্ঞাপন ও অনলাইন কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে, যাতে ক্ষতিকারক বটের প্রতারণা থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়।সাইবার অপরাধীরা এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ফাঁকি দিচ্ছে। এআই-চালিত বটগুলোর কারণে এগুলো আরও বাস্তবসম্মত এবং শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই বটগুলো মানুষের আচরণ অনুকরণ করতে পারে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহজলভ্যতা এবং চুরি হওয়া ডেটার ক্রমবর্ধমান মূল্য ক্ষতিকারক বট আক্রমণের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে।বিশ্বব্যাপী সাইবার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মতে, ভবিষ্যতে ইন্টারনেটে বটের আধিপত্য আরও বাড়বে। ক্রমবর্ধমান সংখ্যক স্মার্ট ডিভাইস, ইন্টারনেট-সংযুক্ত পরিষেবা এবং দুর্বল সুরক্ষাবেষ্টিত ডিভাইস বট ট্রাফিকের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে। ক্ষতিকারক বটগুলোর মাধ্যমে নেটওয়ার্কের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে সিস্টেম অকার্যকর করা হয়, যা ইন্টারনেট বিভ্রাটের কারণ হতে পারে।জেনারেটিভ এআই-এর কারণে বটগুলো মানুষের মতো আচরণ করতে সক্ষম হচ্ছে, যা স্প্যাম এবং অনলাইন প্রতারণার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। তারা কম্পিউটার সিস্টেমের দুর্বলতা খুঁজে বের করে সাইবার আক্রমণ চালানোর ক্ষমতাও অর্জন করেছে। সবচেয়ে বড় হুমকি হলো স্প্যামের ব্যাপকতা, যা “এআই স্লপ” নামে পরিচিত হয়ে উঠছে। এটি ইন্টারনেটে বৈধ তথ্যের প্রবাহকে নষ্ট করছে এবং প্রচুর অপ্রাসঙ্গিক কনটেন্ট ছড়িয়ে দিচ্ছে।তবে এই সমস্যার সমাধানে সতর্ক থাকতে হবে। অনেক প্রযুক্তিগত সমাধান ব্যবহারকারীর গোপনীয়তা লঙ্ঘন করতে পারে, যা আরও বড় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। ফলে, ক্ষতিকারক বট শনাক্ত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।মানুষের পক্ষে বট শনাক্ত করা কঠিন, কারণ বেশিরভাগ বট ওয়েবসাইটের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হয়ে ডেটা সংগ্রহ করে বা পরিষেবার সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিশেষ করে স্বয়ংক্রিয় এআই এজেন্টগুলো মানুষের ছদ্মবেশে থেকে অনলাইন প্রতারণা চালিয়ে যেতে পারে। তবে এআই-চালিত চ্যাটবটদের কিছু নির্দিষ্ট প্যাটার্ন থাকে, যা ব্যবহারকারীরা চিনতে শিখতে পারেন।এআই-উৎপাদিত ছবিতেও কিছু অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেমন হাত ও ঘড়ির অবস্থান ভুল হওয়া, বস্তুর প্রান্ত একে অপরের সঙ্গে মিশে যাওয়া, এবং অস্পষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ড। একইভাবে, এআই-চালিত ভয়েসগুলোতে অস্বাভাবিক টোন ও উচ্চারণ থাকে, যা সহজেই ধরা সম্ভব।সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষতিকারক বটগুলো মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে প্রতারণা চালানোর চেষ্টা করে। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্টে অস্বাভাবিক প্যাটার্ন, চুরি করা বা জেনেরিক প্রোফাইল ছবি, এবং অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পোস্ট করা—এসব লক্ষণ দেখে সন্দেহজনক অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা সম্ভব।কর্পোরেট পর্যায়ে, রিয়েল-টাইম বিহেভিয়োরাল অ্যানালাইসিস স্বয়ংক্রিয় ক্রিয়াকলাপ শনাক্ত করতে পারে, যা মানুষের স্বাভাবিক আচরণের সঙ্গে মেলে না। উদাহরণস্বরূপ, অবাস্তব দ্রুত গতিতে ক্লিক করা বা ফর্ম পূরণ করা স্বয়ংক্রিয় বটের কার্যক্রমের লক্ষণ হতে পারে।ক্ষতিকারক বটগুলোর কারণে ইন্টারনেট নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এআই-এর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বটগুলো আরও জটিল হয়ে উঠছে, যা প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তাই ব্যবহারকারীদের আরও বেশি সতর্ক হওয়া, নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করা এবং সন্দেহজনক কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতন থাকা এখন আগের চেয়ে বেশি জরুরি।ব্যবসার জন্যও ক্ষতিকারক বট বড় হুমকি হয়ে উঠছে। ক্লাউড-ভিত্তিক আইটি ও সাইবার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মতে, একবার যখন কোনো হ্যাকার গোষ্ঠী এই বটগুলো একত্রিত করে, তখন সেগুলোকে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়।এই বটগুলো বড় আকারের আক্রমণ পরিচালনা করতে সক্ষম, যার মধ্যে ব্রুট ফোর্স পাসওয়ার্ড হ্যাকিং, ডিডিওএস (DDoS) হামলা, দুর্বলতা স্ক্যানিং এবং বিভিন্ন সিস্টেমের শোষণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফলে, সাইবার নিরাপত্তা বাড়াতে মাল্টি-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (MFA), ক্যাপচা (CAPTCHA) এবং উন্নত বট শনাক্তকরণ ব্যবস্থা ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত উন্নয়ন নয়, বরং সাধারণ ব্যবহারকারীদের সচেতন করাও এখন অনেক জরুরি, যাতে ক্ষতিকারক বটের প্রতারণা থেকে নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব হয়