নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ, কারখানার নিরাপত্তা এবং নীতি সহায়তায় অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে দেশের শিল্প খাত। শিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে এই তিন ধরনের পদক্ষেপ নিলেই ঘুরতে শুরু করবে অর্থনীতির চাকা। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি হওয়া বন্দর-কাস্টমসে কনটেইনার জট দূর করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও মনে করেন তারা।
শিল্প খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-আগস্টে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একেবারে স্থবির হয়ে পড়ে। ভেঙে পড়ে সাপ্লাই চেইন। যার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিল্প খাত। আর রপ্তানির সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কারণে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে শিল্প খাত। বন্ধ হয়ে যায় কারখানা, ব্যাহত হয় উৎপাদন। আর ইন্টারনেটের কারণে সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দেশ। এতে বায়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারেননি উদ্যোক্তারা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ায় আশাবাদী উদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, সারা বিশ্বে ড. ইউনূসের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। যেহেতু এই ব্যবসা গ্লোবাল; তাই বায়ারদের আস্থা ফেরানো সহজ হবে।
এ বিষয়ে কথা হয় তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, এরই মধ্যে শিল্প খাতের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে অর্থনীতির চাকা সচল করতে প্রথমেই নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে হবে। কারণ চার মাস ধরে তৈরি পোশাক খাতে গ্যাস-বিদ্যুতের চরম সংকট ছিল। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে আগের মতো ফুলফেজে উৎপাদন শুরু হবে কারখানাগুলোতে। আর কারখানা সচল করার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। যেহেতু এরই মধ্যে শিল্প খাতের বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে, সেক্ষেত্রে সরকারের পলিসি সাপোর্ট বাড়াতে হবে। প্রাথমিকভাবে এ তিন পদক্ষেপ শিল্প খাত ঘুরে দাঁড়াতে সহায়ক হবে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকার কারণে বন্দর ও কাস্টমসে যে জট তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে হবে বলেও মনে করেনি তিনি। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা ফেরাতে হবে। যেহেতু আমাদের প্রধান উপদেষ্টা সারাবিশ্বে গ্রহণযোগ্য একজন মানুষ। আর এ কারণে বায়রদের আস্থা ফেরানো তুলনামূলক সহজ হবে বলেও মনে করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নীতি সহায়তা মানেই আর্থিক সাপোর্ট। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আর্থিক সাপোর্টের অনেক কিছু রয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ সরকারকে অনেক কাজ করতে হচ্ছে বা করতে হবে। তাই উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা ছাড়া বাকি সাপোর্ট সরকার দিলেও শিল্প খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, কারখানা চালুর জন্য বা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল করতে গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা প্রয়োজন। এটা যেমন ঠিক, তেমনি সরকারের পলিসি পর্যায়েও সংস্কার করা জরুরি। আর্থিক সুবিধার বাইরে গিয়েও কীভাবে অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, সম্প্রতি রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও কিছু বৈশ্বিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে তাদের পোশাক সংগ্রহ বাড়িয়েছে। পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ায় বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ইমেজ বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস পোলো, গ্যাপ, এক্সপ্রেসের মতো বড় কোম্পানিগুলো তাদের পোশাক সংগ্রহের পরিমাণ বাড়িয়েছে। এমনকি কোরিয়ার পোশাক ব্র্যান্ড বিওয়াইসির মতো নতুন কোম্পানিও এ খাতে যুক্ত হয়েছে।
বিকেএমইর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন এলাকায় আগে যারা মোটরসাইকেল মহড়ার মাধ্যমে হুমকি-ধমকি দিত। এখন অন্য গ্রুপ হুমকি-ধমকি দেয়। এটা বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে গ্যাস-বিদ্যুতের চরম সংকট চলছে, এটা সমাধান করতে হবে। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতে সংস্কার আনতে হবে। আর কাস্টমসের অযৌক্তিক হয়রানি বন্ধ করতে হবে। আর বিদেশি বায়ারদের আস্থা ফেরাতে, তাদের বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, তিনি বায়ারদের সঙ্গে কথা বলবেন। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক। কারণ তিনি সারাবিশ্বে খুবই গ্রহণযোগ্য এবং সমাদৃত। উনার এই উদ্যোগে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। রপ্তানি আরও অনেক বেড়ে যাবে বলেও মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
বিজিএমইর ভাইস প্রেসিডেন্ট নাসির উদ্দিন বলেন, অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে হলে কারখানা সচল করতে হবে। জুলাই-আগস্টে হয়ে যাওয়া ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এর বিকল্প নেই। এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে বন্দরে তৈরি হওয়া জট খুলতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।