
ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটি নতুন এবং বিপ্লবাত্মক পদ্ধতি আশার আলো দেখাচ্ছে। এই পদ্ধতিতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমানোর পাশাপাশি চিকিৎসার সময় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব। সুইজারল্যান্ডের জেনেভার উপকণ্ঠে একটি সুবিশাল ভূগর্ভস্থ গবেষণা কেন্দ্রে এই অভিনব থেরাপির পরীক্ষা চলছে। এখানে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতের নতুন প্রজন্মের রেডিওথেরাপি যন্ত্র তৈরি করতে কাজ করছেন, যা জটিল মস্তিষ্কের টিউমার নির্মূল করা, দূরবর্তী অঙ্গে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সার দূর করা এবং প্রচলিত চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমাতে সক্ষম হবে।এই গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হলো ইউরোপীয় পার্টিকেল ফিজিক্স ল্যাবরেটরি, বা সার্ন। এটি তার বিখ্যাত লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার (এলএইচসি) প্রকল্পের জন্য পরিচিত। এই ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ চৌম্বকীয় রিংটি কণাকে আলোর গতির কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। সার্নের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো ২০১২ সালে হিগস বোসন কণার আবিষ্কার, যা পদার্থের ভর তৈরির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সার্ন তার উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন কণা ত্বরান্বয়ন প্রযুক্তি ক্যান্সারের রেডিওথেরাপি উন্নত করার জন্য ব্যবহার করছে।২০১২ সালে, জেনেভা ইউনিভার্সিটি হসপিটালসের গবেষক মেরি-ক্যাথরিন ভোজেনিন এবং তার সহকর্মীরা একটি নতুন থেরাপি পদ্ধতির ধারণা দেন, যাকে বলা হয় “ফ্ল্যাশ”। এই পদ্ধতিতে রেডিয়েশনকে সেকেন্ডেরও কম সময়ে অত্যন্ত উচ্চ মাত্রায় প্রয়োগ করা হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এই পদ্ধতিতে ইঁদুরের টিউমার ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু আশপাশের সুস্থ টিস্যুগুলো অক্ষত থেকেছে।

ফ্ল্যাশ পদ্ধতির সম্ভাবনা দ্রুতই বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণ করে। বিশ্বজুড়ে গবেষকরা এটি নিয়ে পরীক্ষায় মনোযোগী হন। ইঁদুর, পোষা প্রাণী এবং এখন মানুষের টিউমার চিকিৎসায় এই পদ্ধতির পরীক্ষা চলছে। ফ্ল্যাশ পদ্ধতি প্রচলিত রেডিওথেরাপির দীর্ঘস্থায়ী সীমাবদ্ধতাগুলোর একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে উঠে এসেছে।পেডিয়াট্রিক মস্তিষ্কের টিউমারের ক্ষেত্রে প্রচলিত রেডিওথেরাপি প্রায়শই টিউমার নির্মূল করতে সক্ষম হলেও, এর গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত করে, যা আইকিউ হ্রাস, উদ্বেগ এবং হতাশার মতো সমস্যা তৈরি করে। ফ্ল্যাশ পদ্ধতি এই ধরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমিয়ে চিকিৎসার সম্ভাবনাকে আরও উন্নত করতে পারে।ফ্ল্যাশ পদ্ধতিতে রেডিয়েশনের মাত্রা বৃদ্ধি করে জটিল ক্যান্সার মোকাবিলায় আরও ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, ফুসফুসের ক্যান্সার রোগীদের ক্ষেত্রে রেডিয়েশনের ডোজ বাড়ালে তাদের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়া টিউমারের চিকিৎসা আরও কার্যকর হতে পারে।পশুদের উপর পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে ফ্ল্যাশ পদ্ধতিতে বারবার রেডিয়েশন প্রয়োগ করলেও সুস্থ টিস্যুগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। মানুষের উপরও এই পদ্ধতি পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিনসিনাটি চিলড্রেন’স হসপিটাল এবং সুইজারল্যান্ডের লসান ইউনিভার্সিটি হসপিটাল এই পদ্ধতিতে ক্লিনিকাল ট্রায়াল পরিচালনা করছে।তবে ফ্ল্যাশ পদ্ধতির পরবর্তী ধাপ শুধুমাত্র এর কার্যকারিতা পরীক্ষা নয়। এটি নির্ধারণ করাও গুরুত্বপূর্ণ যে, কোন ধরনের রেডিয়েশন এই পদ্ধতির জন্য সর্বোত্তম। চিকিৎসার এই নতুন পদ্ধতি ক্যান্সার মোকাবিলায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে এবং এর মাধ্যমে অসংখ্য রোগী একটি নতুন জীবন ফিরে পেতে পারেন।