তালিকাভুক্ত ২৮ কোম্পানিকে জেড শ্রেণিতে স্থানান্তরের দিনে গত বৃহস্পতিবার দেশের শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হওয়া শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে প্রায় ৭৬ শতাংশেরই দাম কমেছে। তাতে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৯৭ পয়েন্ট বা পৌনে ২ শতাংশ কমে ৫ হাজার ৬৩৯ পয়েন্টে নেমেছে।
তালিকাভুক্ত ২৮ কোম্পানিকে দুর্বল মানের শ্রেণিভুক্ত করার পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করায় পুঁজিবাজারে কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) গত বুধবার ডিএসইকে এই তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্তের খবরে এদিন ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দাম ৬ টাকা বা সাড়ে ৮ শতাংশ পড়ে যায়। এটিও বাজারের পতনে বড় ভূমিকা রেখেছে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এক দিনে একসঙ্গে এত কোম্পানিকে দুর্বল মানে অর্থাৎ জেড শ্রেণিভুক্ত করার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেনি। যেসব কোম্পানি নতুন করে জেড শ্রেণিভুক্ত হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী সেগুলোর বিপরীতে এখন আর মার্জিন লোন বা ঋণসুবিধা পাওয়া যাবে না। এতে গতকাল এসব কোম্পানির প্রায় প্রতিটিরই সর্বোচ্চ দরপতন হয়েছে, যার ধাক্কা লেগেছে ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ারের দামেও। ইসলামী ব্যাংকসহ বেশির ভাগ ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমেছে। সব মিলিয়ে লেনদেন হওয়া বেশির ভাগ কোম্পানির দাম কমে যাওয়ায় সার্বিক মূল্যসূচকের বড় পতন ঘটে।
এদিন জেড শ্রেণিতে স্থানান্তর হওয়া কোম্পানিগুলোর শেয়ারের ক্রেতার তুলনায় বিক্রেতার সংখ্যা ছিল বেশি। যে কারণে এসব শেয়ার খুব বেশি পরিমাণে হাতবদল হয়নি। ঢাকার বাজারে গতকাল মোট ৫৩১ কোটি টাকার শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের লেনদেন হয়। এই লেনদেন প্রায় এক মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং আগের দিনের চেয়ে ২৬৬ কোটি টাকা বা ৩৩ শতাংশ কম। এর আগে ডিএসইতে সর্বনিম্ন ৫১৯ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল গত ২০ আগস্ট।
ব্রোকারেজ হাউস লংকাবাংলা সিকিউরিটিজের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে গতকাল সূচকের পতনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল ইসলামী ব্যাংকের। তদন্তের খবরে ব্যাংকটির শেয়ারের দামে বড় পতন হওয়ায় ডিএসইএক্স কমেছে ৪৩ পয়েন্ট। একক কোনো কোম্পানির দরপতনের কারণে গতকাল এটিই সূচকের সর্বোচ্চ পতন। এর বাইরে ডিএসইএক্সের পতনে বড় ভূমিকা ছিল ব্র্যাক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বীকন ফার্মা, লিনডে বাংলাদেশ, বিএসআরএম লিমিটেড, রেনাটা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি), অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ ও নাভানা ফার্মার। এই ৯ কোম্পানির শেয়ারের দরপতনে গতকাল ডিএসইএক্স সূচক কমেছে ২৪ পয়েন্টের বেশি।
বাজারের এই পতনের বিষয়ে জানতে চাইলে শীর্ষস্থানীয় দুটি ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একসঙ্গে ২৮ কোম্পানিকে জেড শ্রেণিভুক্ত করা এবং ইসলামী ব্যাংকের তদন্তের খবরে বাজারে তাৎক্ষণিকভাবে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সূচক ও লেনদেন কমলেও উভয় সিদ্ধান্তই দীর্ঘ মেয়াদে শেয়ারবাজারের জন্য ভালো। কারণ, যেসব কোম্পানি বছরের পর বছর বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ ঘোষণা করে না, আবার লভ্যাংশ ঘোষণা করলেও সময়মতো তা দেয় না, সেগুলোকে ভালো শ্রেণিভুক্ত রাখা মানে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা। তাই মানহীন, লোকসানি ও বন্ধ কোম্পানিগুলোর বিষয়ে বিএসইসির নতুন কমিশনকে নতুনভাবে ভাবা উচিত। কারণ, বাজারে এ ধরনের শেয়ার থাকলে কারসাজির হাতিয়ারে পরিণত হয়। তা যাতে না হয়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গতকাল লেনদেনের শুরুতেই ডিএসইএক্স সূচক ৮০ পয়েন্টের বেশি পড়ে যায়। এরপর সূচক কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও ৪৫ মিনিটের মাথায় আবার পতন শুরু হয়। তাতে একপর্যায়ে ডিএসইএক্স সূচকটি আগের দিনের চেয়ে ১১৬ পয়েন্টের বেশি কমে। যদিও দিন শেষে সেখান থেকে কিছুটা পুনরুদ্ধার হয় সূচক।
বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘এক দিনে একসঙ্গে অনেক কোম্পানিকে জেড শ্রেণিভুক্ত করায় বাজারে তাৎক্ষণিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আমি মনে করি, বাজারে যেসব অনিয়ম রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তাতে সাময়িকভাবে বাজারে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও দীর্ঘ মেয়াদে তার সুফল পাওয়া যাবে। তবে বাজারের স্বার্থে সব ব্যবস্থা নিতে হবে স্বচ্ছতা ও আইন অনুযায়ী।’
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গতকাল যে ২৮ কোম্পানিকে জেড শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে ৭টি ডিএসইএক্স সূচকে অন্তর্ভুক্ত নেই। ফলে এসব শেয়ারের দরপতনে সূচকে কোনো প্রভাব পড়েনি। বাকি ২১টির দরপতনে ডিএসইএক্স সূচক ১৫ পয়েন্টের মতো কমেছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, জেড শ্রেণিভুক্ত হওয়া কোম্পানির দরপতনে সূচকে প্রভাব পড়েছে সামান্য। মূলত ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম কমে গেলেই সূচকে বেশি প্রভাব পড়ে।